অন্যান্য
খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। এর ওপর দফায় দফায় গ্যাস, বিদু্যৎ ও পানির মূল্যবৃদ্ধির পর এবার ডিজেলের দাম বাড়ানোয় সংসার খরচে তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় বাড়তি খরচ মেটাতে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সংসারের নিত্য বাজেটে নির্বিচারে কাঁচি চালাতে বাধ্য হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, করোনা মহামারিতে এমনিতেই তাদের আয়-উপার্জন যথেষ্ট কমেছে। অনেকে নিয়মিত পেশা থেকে ছিটকে পড়ে কোনো রকমে বিকল্প পথে জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছেন। এ সময় ডিজেলের দাম বাড়ানোয় নিত্য ব্যবহার্য খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম লাগামহীন পাগলা ঘোড়া হয়ে উঠেছে। গণপরিবহণে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাদের সংসারের অপরিহার্য খরচ মেটানো এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ কাটছাঁট করে সংসারের বাজেট সমন্বয় করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ আবার খাবারের মান কমিয়ে বাড়তি খরচ পোষানোর কৌশল নিয়েছেন। পরিবারের প্রয়োজন অনুযায়ী বাসা ছেড়ে গাদাগাদি করে ছোট বাসায় উঠেছেন। কেউবা ভাড়া বাসায় সাব-লেট দিয়েছেন। শহরকেন্দ্রিক মধ্যম মানের আবাসিক এলাকার বাসা ছেড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঘনবসতিপূর্ণ উপকণ্ঠ এলাকায় সরে গেছেন। স্বল্প দূরত্বের পথ রিকশায় না চড়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন। এমনকি অনেকে পরিবারের চিকিৎসা সেবার বাজেটেও হাত দিতে বাধ্য হয়েছেন। চলতি বছরের ১৬ জুন কনজু্যমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৯ সালে দেশের মানুষ ১০০ টাকা খরচ করে যেভাবে জীবনযাপন করতে পেরেছে, ২০২০ সালে সেটা করতে খরচ করতে হয়েছে ১০৬ টাকা ৮৮ পয়সা। এ সময় খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৬.৩১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর করোনা পরিস্থিতিতে ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত মানুষের আয়-রোজগার একেবারেই কমে গিয়েছিল। এতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে এই বাড়তি ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য অনেক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গড়ে পণ্যমূল্য ৬.৩১ শতাংশ হলেও চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ জরুরি অনেক নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত। রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা সার্ভিসের সংগৃহীত মূল্য থেকে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ক্যাব সূত্র জানায়, গত জুনে এ প্রতিবেদন তৈরির পর খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের কোনোটিরই দাম কমেনি। বরং বেশকিছু ক্ষেত্রে আরও বেড়েছে। সম্প্রতি ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। রাজধানীর মাতুয়াইলের বাসিন্দা প্রকৌশলী শাহ আলম জানান, তিনি পারটেক্স গ্রম্নপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। করোনার শুরুতে চাকরিচু্যত হওয়ার পর তিনি একই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন। তবে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বহন করা তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় তিনি তার ছেলে-মেয়ের প্রাইভেট টিউটর বাদ দিয়ে দিয়েছেন। রিকশাভাড়া নিয়মিত দিতে না পারায় তারা এখন হেঁটেই স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করছে। বাসা ভাড়া থেকে কিছুটা টাকা বাঁচাতে তার তিন রুমের বাসার এক রুম সাবলেট দিয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরে শাশুড়ির ওষুধ খরচ দিলেও এখন তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। উত্তরার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বিধবা মরিয়ম বেগম জানান, তার পরিবারের চার সদস্য গণপরিবহণে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। আগে তাদের গড়ে প্রতিদিন আড়াইশ’ টাকা খরচ হলেও এখন সাড়ে তিনশ’ টাকার কমে তা কোনোভাবেই পারছেন না। অর্থাৎ প্রতি মাসে তার অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা খরচ হবে। মরিয়ম বেগমের ভাষ্য, তার মতো নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে বাড়তি টাকা জোগাড় করা অসম্ভব। এ অবস্থায় আগামী বছরের শুরুতে বড় মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে তাকে ছোটখাটো কোনো চাকরিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। এ বিধবার আশঙ্কা, পণ্য পরিবহণ ভাড়া বাড়ায় জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়লে পরিবারের হাল ধরে রাখা দায় হবে। নাজমুল হক তপনও চাকরি করেন একটি বায়িং হাউসে। বেতন পান ৪৫ হাজার টাকা। দুই সন্তান, স্ত্রী ও বাবাসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। তিনি মাসে বাসা ভাড়া দেন ১৩ হাজার টাকা। খাবার খরচ ২০ হাজার টাকা। ছেলে-মেয়ের স্কুলের বেতন তিন হাজার টাকা। ইন্টারনেট, গ্যাস ও বিদু্যৎ বিল সাড়ে তিন হাজার টাকা। তারপর অফিসে যাওয়া-আসার খরচ। পোশাক, ওষুধ, আত্মীয়স্বজন এলে এ খরচ আরও বাড়ে। তিনি জানান, এক বছর আগে এই টাকায় তার দিব্যি চলে যেত। এখন খরচ বেড়েছে, কিন্তু বেতন বাড়েনি। তাই নানাভাবে ওই টাকায় চলার চেষ্টা করছেন। আগে গরুর মাংস কিনতেন মাসে পাঁচ কেজি, এখন কেনেন দুই কেজি। দুধ কিনতেন মাসে ১০ লিটার, এখন কেনেন পাঁচ লিটার। তারপরও সংসার সামাল দিতে পারছেন না। অর্থনীতিবিদরা জানান, এসব গল্প এখন বাংলাদেশের প্রতিটি মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের। সবাইকেই এখন ‘বাজেট কাটছাঁট’ করতে হচ্ছে। অনেক জিনিস কমিয়ে কিনতে হচ্ছে, অথবা কেনা বাদ দিতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ডক্টর এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম কমার তেমন কোনো আশা নেই। বরং তা আরও বাড়বে। কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে তার সরাসরি প্রভাব নিত্যপণ্যের ওপর পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার প্রভাব কমে যাওয়ায় হঠাৎ করেই সবকিছুর চাহিদা বেড়েছে। জ্বালানি তেলেরও চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। এতে দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম বাড়ানোর কারণে বাজারে এর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে। করোনার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সেটা এখনো আগের অবস্থায় যায়নি। এ অবস্থায় সরকারের নীতির কারণে পণ্যমূল্য বাড়লে ভোক্তাদের জন্য তা অসহনীয় হয়ে উঠবে। অর্থনীতিবিদরা জানান, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ ক্রমবর্ধমান পণ্য ও খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। যা স্বল্প আয়ের লোকদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ক্রয়ক্ষমতা কমায় উৎপাদিত পণ্যও কিনেছে কম। সব মিলে এ চক্রে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক পস্ন্যাটফরমের আহ্বায়ক ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, আয় ও মজুরি কমায় মানুষের ভোগ কমেছে। খাদ্যব্যয় কমিয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। ফলে পিছিয়ে পড়াদের সঙ্গে আরও মানুষ যুক্ত হওয়ার চাপ বাড়ছে। এছাড়া রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতিতে এক ধরনের ভাঙন ধরেছে। আর উৎপাদন ব্যয়-মূল্যস্ফীতি বাড়ায়, চাপে পড়বে নিম্ন মধ্যবিত্ত।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ঢাকা টেলিগ্রাফ এর দায়ভার নেবে না।